হেতমপুর দেওয়ানজি মন্দিরের খোদাই
ঐতিহাসিক স্থান
বৈদিক গ্রহ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, অনর্ব সংহিতা ইত্যাদিতে রামায়ন-মহাভারত এই মহাকাব্যে কিংবা বিভিন্ন পুরাণে পূর্বভারতের পাঁচটি অঞ্চলের উল্লেখ আছে, যথা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ, সুহ্ম এবং পৌণ্ড্র। আজকে এই বীরভূম যে সে সময় সুহ্মভূমি নামে পরিচিত ছিল তার নানান দৃষ্টান্ত আছে। এই সুহ্মভূমিই পরবর্তীতে রাঢ়ভূমি। মৌর্যযুগে বা তার আগে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণে এই রাঢ়ের উল্লেখ আছে। অনেকে মনে করেন মোরদিঘি, মোরগ্রাম, ময়ূরাক্ষী এসবের সঙ্গে না কি মৌর্য নামের যোগ আছে।
গুপ্ত যুগে বালাদিত্যের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে বারা ও নানুরে। নানুরের বেলুটি গ্রামের সঙ্গে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি কালিদাসের বাস ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। মুরারই নিকটবর্তী পাইকর গ্রামে পালরাজাদের নানান নিদর্শন পাওয়া গেছে। শ্যামল বর্মার নামানুসারে লাভপুরের পূর্বনাম সামলাবাদ ছিল বলে জানা যায়। রাজগ্রামের কাছে বীরনগরকে কেন্দ্ৰ করে সেনরাজরংশের বসতি ছিল। আব্দুল ফজলের আইন ই আকবরিতে এ ভূখণ্ডের উল্লেখ আছে। ১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলাকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করেছিলেন। তার মধ্যে বীরভূম ছিল মুর্শিদাবাদের অধীন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস বীরভূমকে বাঁকুড়ার সঙ্গে জুড়ে দেন।পরবর্তীতে বীরভূম একটি স্বতন্ত্র জেলায় পরিণত হয়ে ওঠে।
ইমামবাড়া, রাজনগর
ইতিহাসের নিদর্শন: একজন পর্যটক যে সকল স্থানে গিয়ে ইতিহাস তথা ঐতিহাসিক ভাবে দ্রষ্টব্যস্থান গুলি দেখতে পাবেন, সেগুলি হল -
মতিচুর মসজিদ, রাজনগর
রাজনগর - রাজনগর এক সময়ে বীরভূমের রাজধানী ছিল, রাজা ছিলেন বীরসিংহ। তার বংশধরগণ বীররাজা নামে পরিচিত ছিল। অনেকের মতে এই বীরসিংহ বা বীররাজার নামানুসারে এ জেলার নাম বীরভূম। পরবর্তীতে জোনেদ খাঁর হাতে ১৬০০ সালে বীররাজাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসে। এই বংশেরই শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন আসাদ উল্লা খা (১৬৯৭-১৭১৮)। পলাশী যুদ্ধ পরবর্তীকালে এই পাঠান বংশ ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তবে বংশপরম্পরায় রাজা তার মর্যাদা নিয়েই রাজনগরে অবস্থান করেছেন।
দ্রষ্টব্য: রাজনগরে ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি, ইমামবাড়া, কালীদহ, নহবতখানা, মতিচূর মসজিদ দ্রষ্টব্য। এছাড়া যে গাবগাছে সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক মংলা মাঝিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাও দেখা যাবে।
কিভাবে যাবেন: সিউড়ি সরকপথে রাজনগর কাছেই। যাবার পথে দেখতে পাবেন দাতাবাবার মাজার। কাছেই আছে বক্রেশ্বর, দুবরাজপুর মামা-ভাগ্নে পাহাড় ও হেতমপুর রাজবাড়ি।
মতিচুর মসজিদ, রাজনগর
হেতমপুর রাজবাড়ি
হেতমপুর: রাজনগরের রাজকর্মচারী রাঘবানন্দ একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার নাম রাঘবপুর। পরবর্তীতে সেই গ্রাম রাজনগর রাজা বদিউজ্জামালের সেনাপতি হাতেম খাঁ দখল করলে তার নামানুসারে নামকরণ হয় হেতমপুর। পরবর্তীতে ১৮৭৫ সালের ১৭ ই মার্চ দানবীর রামরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ইংরেজদের কাছে রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন।
দ্রষ্টব্য: রঞ্জন রাজাদের রাজবাড়ি রঞ্জন প্রসাদ এক অসাধারণ স্হাপত্য। এখানে এখনো ভাবেন পুরনো দিনের ঘোড়ার গাড়ি, পালকি ইত্যাদি। গ্রাম ঘুরলে চোখে পড়বে শিব, গৌরাঙ্গ, সরস্বতী মন্দির। এছাড়াও আছে হাফেজ খাঁর বাঁধ, শেরিনা বিবির কবর ইত্যাদি হাতেম খাঁর আমলের নানান নিদর্শন।
কিভাবে যাবেন: বোলপুর থেকে ইলামবাজার হয়ে পানাগড় - মোরগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে পারেন, আবার সিউড়ি থেকেও দুবরাজপুর হয়ে যাওয়া যাবে। রাজনগর, দুবরাজপুর ও বক্রেশ্বরের দ্রষ্টব্য স্হানগুলি খুব কাছাকাছি হওয়ায় বাকিগুলোও দেখে নেওয়া যাবে।
রঞ্জন রাজাদের রাজবাড়ি
রায়পুর জমিদার বাড়ি
রায়পুর: বোলপুর থেকে ইলামবাজারের পথে কাছেই রায়পুর। বলা হয় এর আদিনাম ছিল আদমপুর পরবর্তীতে রায়চৌধুরী জমিদারদের নামানুসারে রায়পুর। আবার কারো মতে বর্ধমান রাজার কাছ থেকে বিশ্বম্ভর সিংহ রায় উপাধি পেয়েছিলেন বলে রায়পুর।
জানা যায় ১৭৬৪ সালে লালচাঁদ দে প্রায় এক হাজার তন্তুবায় নিয়ে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে এই অঞ্চলে আসেন এবং রায়চৌধুরীদের কাছে কিছু জমিদারি কেনেন। তার পুত্র শ্যামকিশোর ( যার নামানুসারে শ্যামবাটি) চিপ সাহেবের কুঠিতে কাপড় জোগান দিয়ে প্রভুত অর্থ উপার্জন করেন। তবে এই বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ যিনি ১৯১৫ সালে কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে বিহার, ওড়িষ্যার গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী এই পরিবারের মহৎ দানের উপর গড়ে উঠেছে।
দ্রষ্টব্য: সিংহ পরিবারের ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি ঘুরে দেখলে মনে হবে ইতিহাস যেন গভীর বিষ্ময়ে এক হারিয়ে যাওয়া গৌরবের দিকে চেয়ে আছে। রায়পুরের কাছেই আছে সুরথেশ্বর শিবমন্দির, ইলামবাজারের শালবন, আমখই গ্রামের ফসিল পার্ক।
কিভাবে যাবেন: বোলপুর থেকে ছোটো গাড়ি কিম্বা টোটো নিয়েও বেড়িয়ে পরতে পারেন। পথের দুপাশে ছায়াঘন প্রকৃতি যে নিজেই সব থেকে বড় দ্রষ্টব্য।
অন্যান্য স্থান: বোলপুরে কাছে সুরুল রাজবাড়ি, বিশেষত সুরুলের দুর্গাপূজা অত্যন্ত বিখ্যাত। কীর্নাহার থেকে কাটোয়া যাবার পথের কাছেই আছে সোনারন্ধি রাজবাড়ি। এছাড়া যদি আপনি ইতিহাস সন্ধানী হন, পাইকর, মিত্রপুর, বারা, বীরনগর, নানুর প্রভৃতি গ্রামগুলিতে ঘুরে প্রাচীন ইতিহাসের নানান উপাদান, কিংবদন্তী, উপকরণ, রাজবাড়ির সন্ধান পাবেন।
সুরুল জমিদার বাড়ি