বাহা শিল্পীরা
কৃষ্টি
শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই নয়, সংস্কৃতি বিশেষত লোকসংস্কৃতির আকরভূমি এই বীরভূম। অসংখ্য লোকায়ত ধারা এই জেলার নানা প্রান্তে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে।
বাউল
২০২৩ সালের জয়দেব মেলায় বাউল গানের পরিবেশনা
বাউলের অর্থ হলো পাগল। আপন অন্তরে বসত করে যে আরশি নগরের পড়শী, সেই মনের মানুষের সন্ধানে ব্রতী মানুষই বাউল। বাউল শুধুমাত্র কোন গান নয়, বাউল হলো এক যাপন অথবা বলা যায় ছোট আমি থেকে বড় আমি পৌঁছানোর সহজিয়া দেহতত্ত্বের সাধনা । আর সে সাধনার মন্ত্রই হলো বাউল গান।
বাংলার বাউল ঘরানায় দুই ধারা একসঙ্গে রয়েছে। একটি পূর্ববঙ্গীয় ধারা আরেকটি রাঢ়বঙ্গীয় । রাঢ় বঙ্গীয় ধারায় বাউলের নিবিষ্ট আখড়া যেন এই বীরভূম। আর এই দুই ধারার মিলন ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
কোথায় পাব তারেঃ বীরভূমে এলে বাউল খুঁজে বেড়াতে হয় না, ট্রেনের কামরায় দোলে বাউলের সুর, বীরভূমের আকাশে বাতাসে খেলে বাউলের আনন্দ লহরী। প্রায় প্রতিটি সতীপীঠে, সোনাঝুরির হাটে, পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় বাউল। বীরভূমের প্রায় সর্বত্র সারাবছরই বেজে চলে বাউলের সুর । এছাড়া জয়দেবের মেলা তো বাউল মেলা রূপে পরিচিত। পৌষ মেলা সহ অন্যান্য মেলাতেও পাবেন বাউলগান। তবে জয়দেবের মতো দু একটি জায়গা বাদ দিলে বাউলের আখড়া আর নেই বললেই চলে। সুফি ভাবনায় আল্লাহ র নামে বিশ্বমানবতা ও সম্প্রীতির ভাবনায় যে গান তাই ফকিরি গান। বীরভূমের বিভিন্ন স্থানে এই ফকিরি গানের প্রচলন দেখা যায়।
বাউল
ভাদুগান কিঃ কথিত আছে পঞ্চকোট রাজা নীলমণি সিং দেও এর কন্যা ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতীর নববর এর বিয়ে করতে আসার পথে মৃত্যু হয় । শোকে বিহ্বল ভাদুমনি আত্মঘাতী হন। তার সেই বিরহ বিধুর কাহিনি স্মরণ করে প্রচলিত হয় ভাদু গান। ভাদু আসলে লৌকিক দেবী। বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমের অন্তজ জীবনের নানান সুখ-দুঃখ, সমকালীন জীবনের সামাজিক বার্তা উঠে আসে ভাদু গানের মধ্য দিয়ে।
কখন কোথায়ঃ মূলত ভাদ্র মাসে ভাদু গান প্রচলিত। সারা ভাদ্র মাস ধরে মূল গায়েন, দোহার, ঢোল, হারমোনিয়াম ইত্যাদি সঙ্গতে দ্বারে দ্বারে ফিরে এ গান গাওয়ার রীতি। সঙ্গে থাকে চাল নেওয়ার ঝুড়ি এবং ভাদুমনির ছোট মূর্তি। দলে নর্তকী ও থাকে এবং ভাদু গানের নৃত্যের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বীরভূমের প্রায় সব ব্লকেই ভাদ্রমাসে ভাদুগান পাবেন।
ভাদুগান
ভাদুগান
রায়বেঁশে
রায়বেঁশে
রায়বেঁশে বীরভূমের বীরনৃত্য। মনে করা হয় পাল সেন রাজাদের ডোম বাউরী, ভল্লা মাল প্রভৃতি বীর সৈনিকেরাই পরবর্তীকালে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এই দেহ কসরত, লাঠিখেলা, রণপা প্রভৃতিকে একত্রিত করে তাদের বিভ্রান্ত বিপথগামিতার পথ থেকে শিল্পীর মর্যাদায় উন্নীত করেন বীরভূমের জেলা শাসক গুরুসদয় দত্ত। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৩৪ সালে এই বীরভূমের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রতচারী সমিতি। আজ রায়বেঁশে বাংলার অন্যতম বীরনৃত্য রূপে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।
কখন কোথায়ঃ নানুরের চারকলগ্রামের রমাপদ প্রামানিক- গোবর্ধন প্রামানিকদের নিয়ে গুরুসদয় দত্ত শুরু করেন রায়বেঁশে। বর্তমানে বীরভূমের নানুর,আমদপুর ইত্যাদি কয়েকটি স্থানে রাইবেঁশে নৃত্য দলের অস্তিত্ব রয়েছে। রায়বেঁশে যেহেতু কোন উৎসব ভিত্তিক নৃত্য নয় তাই বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রায়বেঁশে নৃত্য হয়ে থাকে।
বহুরূপী গ্রাম বিষয়পুর
লাভপুর ব্লকের বিষয়পুর নামের ছোট্ট একটি গ্রাম, গ্রামের মূল বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ পরিবারই প্রাচীন বহুরূপী লোক পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত। সেই কারণে এই গ্রামকে বহুরূপীদের গ্রাম বলা হয়। এই গ্রামের সব বহুরূপীর পদবী হল চৌধুরী (ব্যাধ)। বহুরূপী এদেশের এক প্রাচীন সংস্কৃতি। এক ব্যক্তি এক এক দিন এক এক রূপে নিজেকে প্রকাশ করে। বীরভূমের প্রচলিত রুপ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাম, রাবণ, তারকা রাক্ষসী, তারাসুন্দরী ইত্যাদি। বহুরূপী ছাড়াও এই ব্যাধ গোত্রীয় মানুষ কিছুদিন আগে পর্যন্তও শিকারকে জীবিকার অন্যতম অবলম্বন বলে মনে করত।
কি ভাবে যাবেনঃ লাভপুর থেকে গোপালপুর ভালাস হয়ে বিষয়পুর প্রায় ৮ কিমি পথ। সেখানে পৌঁছালে সারা বিষয়পুর জুড়ে বহুরূপী সম্প্রদায়ের জীবন চর্চা আপনি বুঝতে পারবেন। যাবার পথে লাঘোষা গ্রামে বিশ্বকোষ প্রণেতা রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের সমাধি ও বিপ্লবীদের গ্রাম রূপে পরিচিত ভালাস গ্রাম দেখে নিতে পারবেন।
কখনঃ বহুরূপী দেখানোরও নির্দিষ্ট কোন সময় বা উৎসব নেই। তবে বিজয়ায়, গাজনে ধরমপুজোয় সং সাজার প্রচলন আছে। মূলত শরৎকাল থেকে বসন্ত কাল পর্যন্ত বহুরূপী দেখানোর আদর্শ সময়।
বহুরূপী
গাজন
ধরমপুজোঃ ধর্ম বা ধরম ঠাকুর গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম অনার্য দেবতা বলা যেতে পারে। মূলত অন্তজ জাতির নিজস্ব দেব এই ধর্ম পরবর্তীতে সূর্য- শিব বা বৌদ্ধ ভাবনায় এসে মিলে গেছে। তবে পূজার যে রীতি বা লৌকিক আচার দেখা যায় তা যে সম্পূর্ণরূপে অনার্য প্রভাবিত তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
কোথায়ঃ বীরভূমে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ধরমথান, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিউড়ির কাছে মল্লিকপুর, কোমা, রাজনগরের তাঁতিপাড়া, পুরন্দপুর, আমোদপুর এর নিকটবর্তী বেলে ইত্যাদি অজস্র নাম পাওয়া যায়। বেলের ধর্মরাজের কাছে গেলে বাত ভাল হয় বলে বিশ্বাস আর সেই বিশ্বাসে কাজী নজরুল ইসলাম প্রমীলার রোগ নিরাময়ে ছুটে এসেছিলেন।
গাজন কিঃ কেউ কেউ বলেন গর্জন থেকে থেকে গাজন আবার কারো মতো গাঁ (গ্রামের) জন (জনসাধারণ) যে উৎসবে জমায়েত হয় তাই হল গাজন। ধর্ম ঠাকুরের যেমন গাজন হয় তেমনি চৈত্রসংক্রান্তিতে শিবের গাজন হয় বীরভূমের শিবথান স্থানগুলিতে। কৃচ্ছসাধনের দ্বারা আরাধ্য প্রভুর কাছে নানান লৌকিক আচার পালনের নাম গাজন বলা যায়।
বোলানঃ ধরম পুজো কিংবা চৈত্র গাজনের যে লৌকিক পালা অভিনীত হয় তাকে বলে বোলান। বোলান একটি বিশেষ লোকনাট্য, মূলত ধর্মে বা শিবথানে সারা রাত্রি ধরে এই বোলান অভিনীত হয়।
ধরমপুজো- গাজন ও বোলান